জাপানিদের অতি নমনীয় আর বিনয়ী স্বভাব সম্পর্কে বইপত্র, পেপার-পত্রিকা, বন্ধুবান্ধব বা ইন্টারনেটের মাধ্যমে আমরা কম-বেশি অনেকেই জানি। তারপরও জাপানে প্রথম দিন এসে একজন জাপানি নারীর ভদ্রতা আমাকে যারপরনাই অবাক করেছে।
রাতে বুলেট ট্রেনে ওঠার নির্ধারিত সময়ের কিছু আগে স্টেশনে এক রেস্টুরেন্টে ভেজিটেবল নুডুলস স্যুপ আর ফ্রেঞ্চ ফ্রাই অর্ডার দিই আমরা। যতটুকু সময় লাগবে ভেবেছিলাম, তার চেয়ে আরো ১০ মিনিট বেশি লাগল খাবার আসতে। একদম ধোঁয়া ওঠা স্যুপ খেতে খেতে ট্রেনের প্ল্যাটফর্মের গেইটে যাওয়ার সময় চলে আসে। জাপানে একেবারে নতুন আমরা বলা যায়। তাই শেষ মুহূর্তে বাচ্চা-কাচ্চাসহ ট্রেনে উঠতে তাড়াহুড়ো না লেগে যায়, সে জন্য বর মহাশয় তাড়া দিলেন খাবার শেষ করার জন্য। এই গরম স্যুপ জলদি শেষ করা মানে জিহ্বা, মাঢ়িসহ আলজিহ্বাও পুড়িয়ে ফেলা।
আমার নেতিবাচক, বাংলা ‘ঙ’-এর মতো কুঁচকানো ঠোঁট দেখে আমার বাচ্চাদের আব্বা ওই নারী পরিচারিকাকে জাপানি ভাষায় বোঝালেন, আমাদের ট্রেনের সময় হয়ে এসেছে। খাবারটা পার্সেল করে দিলে ভালো হয়। খেয়াল করলাম, দ্রুত গতিতে উনি পার্সেল করার কথা শুনে রীতিমতো হৃদযন্ত্রে তীর লাগার মতো ব্যথা অনুভব করলেন। ভীষণ কষ্টভাবাপন্ন মুখ নিয়ে ও সেই সঙ্গে স্মিত হাসি দিয়ে জানালেন, এই ধরনের ঝোল জাতীয় খাবার উনাদের টেইক অ্যাওয়ে অর্থাৎ পার্সেল করার ব্যবস্থা একদম নেই। এ জন্য উনারা অন্তর থেকে অসম্ভব দুঃখিত যে, আমরা ক্ষুধার্ত অথচ এই খাবার অর্ধেক খেয়েই বিদায় নিতে বাধ্য হচ্ছি।
এই ব্যথাতুর মুখ ও মন নিয়ে মাথা সামনের দিকে ঝুঁকে, কোমড় প্রায় ৯০ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে নুয়ে নুয়ে বারবার দুঃখ প্রকাশ করছেন ওই নারী পরিচারিকাটি। চোখের মণি বড় করে অবাক বিস্ময়ে তা দেখে চেয়ারে বসে আর নিজেকে শান্ত রাখতে পারলাম না। আমিও সঙ্গে সঙ্গে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে ঝুঁকে ঝুঁকে আবেগে ঠিক আছে আপু, ঠিক আছে আপু, ইটস ওকে ইটস ওকে বলতে লাগলাম কখন টেরই পাইনি। বাচ্চারা গুঁতা মেরে আমার হুঁশ এনেছে যে আমি ওদের সঙ্গে বাংলা বলছি।
গল্পে শোনা, বইয়ে পড়া, টিভি স্ক্রিনে দেখা আর সামনাসামনি দেখার মধ্যে সত্যি বিস্তর ফারাক থাকে। আজ অন্যভাবে সেটা আবিষ্কার করলাম।
যা-ই হোক, শেষ পর্যন্ত উনি ফ্রেঞ্চ ফ্রাই পার্সেল করে দিলেন আর বিদায় নিতে নিতেও বলতে লাগলেন, গোমেনাসাই গোমেনাসাই, আরিগাতো গোজাইমাসতা, আরিগাতো গোজাইমাসতা অর্থাৎ স্যরি স্যরি, থ্যাংক ইউ, থ্যাংক ইউ।
রেস্টুরেন্ট থেকে প্ল্যাটফর্মের দিকে যেতে যেতে মনে হচ্ছিল, হায় আল্লাহ! এই সামান্য ব্যাপারে উনি সত্যি এত কষ্ট পেলেন নাকি অভিনয়! নাকি এতটাই বিনয়ী, ভদ্র উনারা! আরো মনে হলো, আর জীবনেও তাড়াহুড়ায় যদি এই ঝোল জাতীয় খাবার অর্ডার দিসি! দিলেও খাওয়া শেষ না হলে পার্সেলের কথা মনেও আনব না। কসম! আমার তো মনে পড়ে না জীবনে আমি শেষবার এরকম বিনয় কবে কার সঙ্গে দেখিয়েছিলাম!
দুই
হেঁটে রাস্তা পার হব। বাংলাদেশের পরিচিত গলি টাইপ চিকন রাস্তা। হঠাৎ একটা পাজেরো গাড়ি আসতে দেখলাম। স্বাভাবিকভাবেই আমি দাঁড়িয়ে গেলাম গাড়িটি যাতে রাস্তা পার হতে পারে। খেয়াল করলাম, গাড়িটিও চিকন রাস্তার মাথার দিকেই দাঁড়িয়ে গেল। আমার থেকে প্রায় ছয়-সাত হাত দূরত্বে। পার হব নাকি হব না! কী ব্যাপার! গাড়িটা থামল কেন! হাঁটার বা গাড়ি চলার সিগনাল দিয়েছে কিনা সিগনাল স্ট্যান্ডে বারবার খেয়াল করছি। বাচ্চাদের আব্বা সাইকেলে করে আমার ছেলেটাকে নিয়ে একটু সামনে চলে গিয়েছে। দ্বিধায় পড়ে গেলাম তো বড়ই, রাস্তা পার হবো কি না! চিন্তায় পড়ে গেলাম।
একে তো নতুন এখানে, তার ওপর কিসে কী করে ফেলি সেই ভাবনা। আত্মবিশ্বাসের বারোটা। তবে এখানে আমার মাথায় থাকে, আমি যা-ই করি না কেন, তা আমার পুরো পরিবার ও আমার দেশকে প্রতিনিধিত্ব করে। তাই অনেক ছোটখাটো বিষয়েও বেশ সাবধানী থাকি। তো প্রায় ৪০-৪৫ সেকেন্ডের মাথায় খেয়াল করলাম, গাড়ির মোটা গ্লাসের এপাশ থেকে গাড়িচালক সদ্য চেনা মুগ্ধ করা হাসিমুখে হ্যাঁ-সূচক মাথা ওপর-নিচ ওপর-নিচ অনবরত নাড়িয়ে যাচ্ছেন। উনাকে দেখতে একদম চাবি দেওয়া বৃদ্ধ পুতুলের মতন লাগছিল। আমার একটা ছিল, চাবি দিলেই কী দারুণভাবে মাথা আর কোমড় নাচাত! মনে পড়ে গেল সেই পুতুলটার কথা। আমার বান্দর বাচ্চারা সেটা ভেঙে ফেলেছে। আচ্ছা, আজকালকার বাচ্চারা খেলনা এত ভাঙে কেন!
যাকগে। প্রায় ৮-৯ সেকেন্ড উনার মাথা হ্যাঁ-সূচক নাড়ানি দেখে চট কতে মাথায় ক্লিক করল, বাচ্চাদের আব্বা বলেছিল আমাকে, যেসব সরু রাস্তায় সিগনাল অপশন নেই, এরকম পজিশনে ওরা মানুষকে আগে যেতে দেয়। রাস্তা পার না হওয়া পর্যন্ত ওরা হাঁটা মানুষকে থামিয়ে বা অপেক্ষায় রেখে স্বভাবত যায় না। তখনই ব্যাপারটা ধরতে পেরে আমিও দাঁত কেলানো হাসি দিয়ে হ্যাঁ-সূচক মাথা ঝাঁকুনি দিতে দিতে রাস্তা পার হলাম মেয়েকে নিয়ে। পার হয়ে দেখলাম, ফাঁকা রাস্তায় যথেষ্ট স্বল্প গতিতে উনি গাড়ি চালিয়ে চলে গেলেন। অবাক হয়ে গেলাম। এই গল্প শুনেছি আমি। অথচ আজ সামনাসামনি দেখে যেন আরো বিস্ময় বাড়ল। এত ব্যস্ত এরা কাজ নিয়ে, তার পরও খেয়াল করলাম, নির্দিষ্ট মাত্রাতেই এরা গাড়ি চালায়। পরক্ষণেই ভাবলাম, আসলে এটাই তো এদের সিস্টেম। আর এরা সিস্টেম পুরোপুরি অনুসরণ করে। বাহাত্তর ঘণ্টার ব্যবধানে বলা যায়, এখানে আমি আবারও অবাক হলাম।
আরেকটা ছোট বিষয় এই সংক্রান্তই। এটা দুই চাকার সাইকেল নিয়ে। শুনেছিলাম, ফুটপাথ দিয়ে হাঁটার সময় পেছনে কোনো সাইকেল আরোহী চলে এলে সাইড না পেলে ধীরগতিতে পেছন পেছন এগোবে। তবু আপনাকে সরানোর জন্য সাইকেলের ঘণ্টা বাজাবে না। হর্ন দেওয়া, সাইকেলের বেল বাজানো মানে এখানে অসম্মান দেখানো, গালি দেওয়ার শামিল।
সেদিন আরেক বাঙালি ভাইয়ের সঙ্গে হঠাৎ দেখা হওয়ায় ফুটপাথে হাঁটতে হাঁটতে গল্প করতে করতে কখন যে আমরা ফুটপাথ দখল করে নিয়েছি খেয়াল করিনি। তাও মাত্র এক মিনিটের মতন হবে। এরই মধ্যে আমি সামান্য পিছিয়ে যাই। খেয়াল করলাম, একজন সাইকেল আরোহী সাইকেল চালিয়ে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার রাস্তা না পেয়ে ধীরগতিতে ওদের পেছন পেছন এগোচ্ছে। আমি ব্যাপারটা খেয়াল করে আরেকটু দেখতে লাগলাম। বলা যায় পুরো বিষয়টা উপভোগ করতে লাগলাম। কিছুক্ষণ ঘটনাটা উপভোগ করার পর আমি একটু জোরে হেঁটে ওদের পেছনে গিয়ে বলি, পেছনে সাইকেল, সাইড দাও। ওরা তাড়াতাড়ি সরে যায়, সাইকেল আরোহী সঙ্গে সঙ্গে মাথা ঝুঁকে ঝুঁকে সদ্য চেনা হাসি হেসে লাজুক ভঙ্গিতে সাইকেল চালিয়ে চলে গেল।
আমার মাথায় এটাই আসে যে এরা এত ব্যস্ত, এত কাজ করে, তাও তাড়াহুড়ো কম দেখছি এদের মধ্যে। যা দেখলাম, তা হলো কেবলই অন্যকে সেবা দেওয়া আর সম্মান দেখানোর মানসিকতা।
মেট্রোপলিটন সিটি অফিসে গিয়েছিলাম জরুরি কাজে। পুরোদস্তুর সরকারি অফিস। সেখানে কিছু নিয়মনীতির অভিজ্ঞতা পরবর্তী লেখায় লিখব ইনশা আল্লাহ।
তিন
টয়লেট বা মলমূত্র ত্যাগকারী স্থান অথবা সহজ বংলায় পায়খানার জগতে চরম বিস্ময়কর এক আবিষ্কার ওয়াশলেট।
ওয়াশলেট হলো এমন একধরনের যান্ত্রিক কমোড, যেখানে মলমূত্র ত্যাগ করার পর নির্দিষ্ট বোতামে চাপ দিলে কমোডে বসার আসনের পেছনে ঠিক মাঝ বরাবর স্থান থেকে ছয়-সাত ইঞ্চি মাঝারি আকৃতির একটি নল বেরিয়ে এসে ঝরনার মতো পানি ছিটিয়ে দিয়ে আপনার মলমূত্র নির্গমনের স্থানটি যত্নসহ পুরোপুরি পরিষ্কার করে আপনাআপনি আবার আগের জায়গায় নলটি কমোডের অন্দরে ঢুকে যাবে। নলটিও বিশেষভাবে স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে যথেষ্ট পরিচ্ছন্ন থাকে এবং নলটি তার কাজ পূর্ণাঙ্গ দায়িত্বসহ পালন করে বিধায় জীবাণু ছড়ানোর বা অপরিষ্কার থাকার প্রশ্নটি মনে জাগে না। আবার মনের ভেতর খুঁতখুঁতে ভাবটাও আসে না। তারপর ফ্ল্যাশ করে ওয়াশলেট থেকে যথারীতি বেরিয়ে আসবেন। কত সহজ! আহা!
এই যান্ত্রিক কমোডে কাজ সারলে হাত বা টিস্যু—কোনোটাই ব্যবহারের প্রয়োজন পড়ে না। অতি বাস্তব ও সত্য কথা। বুঝতে হবে।
এখন কথা হলো, এটা আপনার কাছে কতটুকু বিস্ময়ের আমি জানি না। তবে আমার কাছে ব্যাবিলনের শূন্য উদ্যান দেখার মতো বিস্ময়কর ব্যাপার। যদিও এরকম কমোডের কথা আমি ’৯৫-’৯৬ সালের দিকে শুনেছিলাম আমার একমাত্র বড় বোন কুমকুম আপুর কাছ থেকে। আপুর ভাসুর ষাটের দশক থেকে লন্ডনে থাকেন। যখন আমি প্রথম ইংলিশ কমোড চোখে দেখি ও ব্যবহার করি, তখন আমি এটা শুনি যে, লন্ডনে এমন এক কমোড আছে যেটাতে নাকি ঘটি, বদনা বা হ্যান্ড শাওয়ার কিছুই ব্যবহার করা লাগে না। কেবল সুইচ টিপলে পানির স্রোত এসে সব কাজ করে দিয়ে চলে যায়।
কী তাজ্জব ব্যাপার গো মা! এক কমোডই আমার কাছে সপ্তাশ্চর্য বিষয়! তার ওপর সুইচ টিপে শৌচ করার ব্যাপার! ভাবতেই মাথা-ঘাড় গুবলেট পাকানোর মতন অবস্থা।
তারও পরে এই যান্ত্রিক বস্তুটির ব্যাপারে অনেকবারই জানার ও শোনার সুযোগ হয়। কিন্তু কানে শোনা আর চোখে দেখা কি এক জিনিস বাবা! মোটেও না।
তো নানান বিকল্প বোতাম সমৃদ্ধ এক হাতল ওয়ালা এই যান্ত্রিক কমোডের আসনে বসলে আমার নিজেকে হিন্দি সিনেমা কৃষ থ্রির কাল (Kaal) ওরফে বিবেক ওবেরয়ের মতন মনে হয়। মনে হয়, এখনি এই এক হাতল ওয়ালা সিংহাসন চলতে শুরু করবে।
যা-ই হোক। আগের অভ্যাস অনুযায়ী টয়লেটের সাইড ওয়ালে হাতড়ে কয়েকবার হ্যান্ড শাওয়ার খুঁজলেও বিবেকের মতোই বোতাম চাপতে হয়েছে। তবে স্বীকার করতেই হয়, যে পরিমাণ পানির চাপ ওই নলটিতে কমোডটির কম্পানি নির্ধারণ করে দিয়েছে, তা কাজ উপযুক্তভাবে সারার জন্য যথেষ্ট। এ জন্য সত্যি এই যন্ত্রটির আবিষ্কারককে মন থেকে ধন্যবাদ ও সাধুবাদ জানাই। আরেকটা কাজ, লম্বা অভ্যাসগত কারণে ওই কাজে সরাসরি হাত ব্যবহৃত না হলেও পরবর্তী সময়ে হাত সাবান দিয়ে ধোয়া ও পা, মুখ ধোয়া এখনো শুধু শুধুই অব্যাহত রেখেছি কেন যে জানি না। মানুষকে অভ্যাসের দাস হতে দেওয়া যাবে না। অভ্যাসকে মানুষের দাস করতে হবে। তাই না?
যাকগে সে কথা। এবার জেনে নিই এই ওয়াশলেট জাপানে এল কবে।
আশির দশকে ওয়াশলেট কমোড জাপানে আসার পরপরই ভীষণ জনপ্রিয়তা পায়। এখন পুরো জাপানে প্রায় ৭১ শতাংশ বাসায় ওয়াশলেট ব্যবস্থা রয়েছে। এটি ৯৯ শতাংশ পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখে। এ জন্য এটির ব্যবহারকে ১০০ ভাগে উন্নীত করার জন্য এখানকার জনগণকে উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। এটি বিশেষ করে বৃদ্ধ, শিশু, অসুস্থ মানুষদের জন্য সত্যি এক আশীর্বাদস্বরূপ। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখার ক্ষেত্রে জাপানিরা বিশ্বের অনেক শীতপ্রধান দেশ থেকে এগিয়ে।
পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতাই জীবন এবং এটি ঈমানের অঙ্গ। সার্বিকভাবে পরিষ্কার থাকাই আমাদের কাজ। এই যন্ত্র ব্যবহারে আমরা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকলে এবং একটু সময় বাঁচিয়ে আরেকটি জরুরি কাজে লাগাতে পারলেই তথাস্তু। আলহামদুলিল্লাহ।
সবাই সুন্দর, সুস্থ, পরিষ্কার, জীবাণুমুক্ত ও হাসিখুশি থাকবেন। শুভ নববর্ষ। শুভ ও নিরাপদ হোক সবার পথচলা। মঙ্গল কাজে ও চিন্তায় ভরে যাক আমাদের সময়গুলো।
—ফারহানা মোস্তারী বিনতে হক, জাপানপ্রবাসী