ঢাকার মধ্যভাগে প্রতিষ্ঠিত হাতিরঝিল-বেগুনবাড়ি প্রকল্প বাস্তবায়নের পর এর নয়নাভিরাম সৌন্দর্য ও পরিবেশগত গুরুত্বের নিরীখে একে ‘ঢাকার ফুসফুস’ বলে অভিহিত করেছেন অনেকে। তবে বাস্তবায়নের কয়েক বছরের মধ্যেই এর মূল নকশা বহিভর্’ত নানা রকম বাণিজ্যিক স্থাপনা গড়ে ওঠা এবং নানা রকম অসামাজিক ও অপরাধমূলক কার্যকলাপ বেড়ে যাওয়ায় এর স্বাভাবিক সৌন্দর্য ও নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা দেখা দেয়।
বিশ্বের উষ্ণায়ণ ও জলবায়ুর পরিবর্তনের নানাবিধ প্রভাব-প্রতিক্রিয়া মোকাবেলায় বিশ্বসম্প্রদায় ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে অঙ্গিকারাবদ্ধ। ফসিল জ্বালানির মাত্রাহীন অপরিমিত ব্যবহার এবং অপরিকল্পিত শিল্পায়ণ, নগরায়ণের পাশাপাশি নির্বিচার বৃক্ষ কর্তনসহ প্রাকৃতিক পরিবেশ ধ্বংসকারী উন্নয়ন ও বাণিজ্যিক প্রকল্প বিশ্বের দেশে দেশে নগরসভ্যতা জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা দু’কোটি মানুষের শহর ঢাকা নগরীতে মানুষের বুক ভরে নিঃশ্বাস নেয়া ও সকাল-বিকালে হাঁটা-চলা বা বেড়ানোর স্থান খুবই সঙ্কুচিত হয়ে পড়েছে। অথচ বৃটিশ আমলে এই শহরটিকে গ্রিনসিটি বলে অভিহিত করা হতো। শহরের চারপাশে নদী, শহরের বুক চিরে অসংখ্য খাল ও জলাভ‚মি এবং সর্বত্র সবুজের সমারোহ ছিল এই শহরের মূল বৈশিষ্ট্য।
স্বাধীনতার ৫০ বছরের মাথায় এই স্বপ্নের শহরটি এখন যানজট, পানিবদ্ধতা, ময়লাজট, পরিবেশগত বিপর্যয়সহ ও নানাবিধ নাগরিক সংকটে দুর্ভোগের শহরে পরিনত হয়েছে। শহরটিকে তার হারানো ঐতিহ্য ও সৌন্দর্যে ফিরিয়ে নেয়ার লক্ষ্য হিসেবে শহরের সবচেয়ে নোংরা-পুঁতিগন্ধময় এলাকায় হাতিরঝিল-বেগুনবাড়ি প্রকল্প বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে প্রমানিত হয় ঢাকাকে এখনো তার সবুজ ঐতিহ্যে ফিরিয়ে নেয়া সম্ভব।
দীর্ঘ মেয়াদি নগরায়ণ প্রকল্প বাস্তবায়ন, সৌন্দর্যবর্ধন ও পরিবেশগত পুনর্বিন্যাস ও আধুনিক নাগরিক সুযোগ সুবিধার রূপরেখাগুলো যথাযথভাবে বাস্তবায়ন ও সংরক্ষণের মাধ্যমেই তা সম্ভব হতে পারে। হাতিরঝিলের মূল নকশা ও বৈশিষ্ট্য সুরক্ষা এবং যথাসম্ভব তার সম্প্রসারণের উদ্যোগ নিতে হবে। শহরের চারপাশের নদনদী, লুপ্তপ্রায় সবগুলো খাল, জলাভ‚মি এবং পার্কগুলো ঘিরে এ ধরণের আরো বেশ কিছু উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে ষাটের দশকের ডিএনডি প্রকল্প এলাকার লাখ লাখ মানুষের পানিবদ্ধতা দুর্ভোগ লাঘবে হাতিরঝিলের অনুরূপ প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিতে হবে।
ঢাকা শহরকে বাসযোগ্য, পরিচ্ছন্ন ও পরিবেশবান্ধব করে তুলতে হলে শহরের ভেতরে গড়ে ওঠা শিল্প কারখানা স্থানান্তরের তাগিদ দিচ্ছেন নগরবিদরা। অবস্থা এখন এমন দাড়িয়েছে যে, শহরের অভিজাত আবাসিক এলাকা হিসেবে পরিচিত গুলশান, বনানি, বারিধারা, ধানমন্ডি থেকে শুরু করে সব আবাসিক এলাকাই স্বাভাবিক সৌন্দর্য ও বৈশিষ্ট্য হারিয়েছে। একই স্থানে পাশাপাশি গড়ে উঠছে আবাসিক ভবন ও শিল্পকারখানা।
এমনকি এসব অভিজাত এলাকায়ও একই ভবনের অর্ধেকটা বাণিজ্যিক বাকি অর্ধেক আবাসিক অ্যাপার্টমেন্ট হিসেবে ব্যবহৃত হতে দেখা যাচ্ছে। হাতিরঝিল প্রকল্পের বহু আগে থেকেই গুলশান-বনানি লেকের সংস্কার প্রকল্প হাতে নেয়া হলেও গত ১৫ বছরেও তার বাস্তবায়ন হয়নি। একইভাবে ডিএনডি প্রকল্পের ভেতরে দশকের পর দশক ধরে লাখ লাখ মানুষ অশেষ দুর্ভোগ পোহালেও এখানের পানিবদ্ধতা নিরসনসহ সামগ্রিক নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত করার কোনো উদ্যোগ ফলপ্রসু হয়নি।
ঢাকার হাতিরঝিল প্রকল্পের অনুকরণে নারায়ণগঞ্জ শহরের পরিত্যক্ত-অপরিচ্ছন্ন এলাকা বাবুরাইল খালকে নয়নাভিরাম শেখ রাসেল ইকোপার্কে পরিণত করার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন। ডিএনডি এলাকাসহ ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুরসহ রাজধানীর চারপাশের এলাকার পরিকল্পিত উন্নয়ন ও সবুজায়নের মেগা প্রকল্প নিয়ে কাজ শুরু করতে হবে। শুধু হাতিরঝিলই নয় শহরের প্রতিটি পাবলিক প্লেসকেই ‘পাবলিক ট্রাস্ট’ হিসেবে সংরক্ষণের উদ্যোগ নিতে হবে। এসব স্থানকে বাণিজ্যিক ও অসামাজিক কার্যক্রম থেকে মুক্ত রাখার ক্ষেত্রে হাইকোর্টের নির্দেশনার আলোকে দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে।